শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক নথিতে অভিমত দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পরে কৌশলে ঘষামাজার মাধ্যমে ওই নথির সিদ্ধান্তই বদলে দিয়েছিল একটি জালিয়াত চক্র। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি মামলাও করা হয়েছিল। সম্প্রতি ঘষামাজা করা ওই নথি, যা একই সঙ্গে মামলার গুরুত্বপূর্ণ দলিল, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে খোয়া গিয়েছে। এ ঘটনার তদন্তে এরই মধ্যে একটি কমিটিও গঠন করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয় অনুবিভাগ) একেএম আফতাব হোসেন প্রামাণিক বলেন, নথিটি প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় ছিল। তাই কোন ধাপ থেকে নথিটি হারিয়েছে, সেটি অনুসন্ধানের জন্যই একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সম্প্রতি কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আরো একটি চিঠি দেয়া হয়েছে।
গত বছর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তিনজনের নামের প্রস্তাব সংবলিত ওই নথিতে প্রধানমন্ত্রী অভিমত দেয়ার পর তা কার্যালয় থেকে বের করে জালিয়াতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বদলে দেয় একটি চক্র। পরে আবার সেই নথি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাষ্ট্রপতির চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বঙ্গভবনে পাঠানো হয়। জালিয়াতির ঘটনাটি ধরা পড়লে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ৫ মে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করা হয়। পরবর্তী সময়ে আদালত থেকে মামলাটির তদন্তের ভার দেয়া হয় দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক)।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান এনামুল হক, বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রউফ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিউপি) সাবেক কোষাধ্যক্ষ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর এম আবদুস সালাম আজাদের নাম প্রস্তাব করে সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নথিটি প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করার পর তিনি অধ্যাপক এনামুল হকের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেন। পরে ফাতেমা বেগম নামের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন অফিস সহকারী তরিকুল নামের একজন ছাত্রলীগ নেতার কাছে নথিটি তুলে দেন। জালিয়াতির মাধ্যমে এম এনামুল হকের নামের পাশে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া টিক চিহ্নটি ‘টেম্পারিং’ করা হয়। ক্রস চিহ্ন দেয়া হয় অধ্যাপক মো. আবদুর রউফের নামের পাশেও। টিক চিহ্ন দেয়া হয় এম আবদুস সালাম আজাদের নামের পাশে। পরে তা পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে। সেখানেই জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৭ মোহাম্মদ রফিকুল আলম বাদী হয়ে গত বছরের ৫ মে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। এরপর গত বছরের ১১ জুলাই ছাত্রলীগ নেতা তরিকুলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
এরপর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
এদিকে মন্ত্রণালয় থেকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নথিপত্র গায়েব হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। কয়েক বছর আগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। যদিও কয়েক মাস আগে প্রতিবেদনটির প্রয়োজন পড়লে খুঁজে না পাওয়ায় পুনরায় কমিশন থেকে প্রতিবেদনের একটি কপি সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয়। এরও আগে নর্থ সাউথের একজন উপ-উপাচার্যের নিয়োগ-সংক্রান্ত একটি নথির কয়েকটি অনুলিপিও অদৃশ্য কারণে গায়েব হয়ে যায়। এমনকি উপ-উপাচার্য হিসেবে যিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন, তিনিও তার নিয়োগ-সংক্রান্ত চিঠিটি হাতে পাননি। এছাড়া চিঠির একটি অনুলিপি ইউজিসির চেয়ারম্যানকে পাঠানোর রীতি থাকলেও তিনি তা পাননি।
এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, নর্থ সাউথ টাকার বিনিময়ে তাদের অনেক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ঢাকতে চায়। আমি দায়িত্বে থাকাকালে রাষ্ট্রপতি একজন উপ-উপাচার্যকে নিয়োগ দেয়ার পরও যোগদান করতে দেয়া হয়নি। নিয়োগের চিঠিই গায়েব করে দেয়া হয়। ইউজিসি চেয়ারম্যান হিসেবে আমার একটা কপি পাওয়ার কথা ছিল, সেটিও পাইনি। ঘটনা জানার পর দাপ্তরিক প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে ওই চিঠির একটি অনুলিপি সংগ্রহ করেছিলাম। আমি দায়িত্বে থাকাকালীন নর্থ সাউথ বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। পরে শুনলাম সে প্রতিবেদন নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। এটা তো এক-দুই পৃষ্ঠার কাগজ নয় যে হারিয়ে যাবে। প্রতিবেদন ও সংযুক্তি মিলে কয়েকশ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন কীভাবে হারাল?
Comments are closed.