প্রশ্নফাঁস : রাতে উত্তর মুখস্থ করানো হয় ১০১ চাকরিপ্রার্থীকে

প্রশ্নফাঁস : রাতে উত্তর মুখস্থ করানো হয় ১০১ চাকরিপ্রার্থীকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের বাতিল হওয়া সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াও গেল তিন বছরে অন্তত চারটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন একইভাবে ফাঁস করে উত্তর বিক্রির কারবার করা হয়েছে। গত ৬ নভেম্বর নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে কেন্দ্রের কাছে ১০টি বাসায় বুথ বানিয়ে ১০১ চাকরিপ্রার্থীকে উত্তর মুখস্থ করানো হয়। আরো শতাধিক প্রার্থীকে অনলাইনে উত্তর দেওয়ায় তা ছড়িয়ে পড়ে।
আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির রেজিস্ট্রার অফিসের সহায়ক দেলোয়ার হোসেন প্রশ্ন খামে ভরার সময় চুরি করতেন। সেই প্রশ্ন দেলোয়ার দিতেন আইসিটি সেন্টারের ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পারভেজ মিয়া ও টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েলকে। তাঁদের কাছ থেকে পেত ব্যাংকার সিন্ডিকেট। গ্রেপ্তার হওয়া ছয়জনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল শনিবার রিমান্ড শেষে জনতা ব্যাংকের অফিসার (বরখাস্ত) সামশুল হক শ্যামল ও আহছানউল্লার কর্মী রয়েল ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এক দফায় ১০১ জনের কাছে প্রশ্নোত্তর বিক্রি হওয়ায় অন্য চার নিয়োগ পরীক্ষায় অন্তত ৪০০ জন প্রার্থীর কাছে বিক্রি হয়েছে বলে ধারণা করছেন তদন্তকারীরা। তাঁরা বলছেন, ৬ নভেম্বরের পরীক্ষার তদন্তের সূত্র ধরে আগে যাঁরা জালিয়াতি করেছেন, তাঁদেরও শনাক্ত করা হবে।
এদিকে ৬ নভেম্বরের পরীক্ষা বাতিল করা হলেও আগের চার পরীক্ষার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আগের নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকায় যথাযথ নিয়ম মেনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তদন্তে যদি অপরাধের প্রমাণ মেলে তবে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ৬ নভেম্বর পাঁচ ব্যাংকের এক হাজার ৫১১টি অফিসার (ক্যাশ) শূন্যপদের নিয়োগ পরীক্ষা হয়। আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব পেলে গত তিন বছরে আরো চারটি নিয়োগ পরীক্ষা হয়। এগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকের এআইও ৪৬৪ পদে, জনতা ব্যাংকের টেলার ৫৩৬ পদে, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের সমন্বিত ৮৮৯ অফিসার পদে এবং রূপালী ব্যাংকের ৪২৩ সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষা হয়। সব কটি পরীক্ষায় একইভাবে জালিয়াতি হয়েছে।
তদন্তকারী সূত্র জানায়, রেজিস্ট্রার অফিসের অফিস সহকারী দেলোয়ার হোসেন প্রশ্নপত্র খামে ভরার সময় চুরি করে রয়েল ও পারভেজকে দিতেন। রয়েল সেই প্রশ্ন দিতেন জনতা ব্যাংকের অফিসার সামশুল হক শ্যামল এবং রূপালী ব্যাংকের জানে আলম মিলনকে। মিলন ও শ্যামলের মাধ্যমে প্রশ্ন চলে যেত জনতা ব্যাংকের অফিসার এমদাদুল হক খোকন ও পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের কাছে। তাঁদের তত্ত্বাবধানে রাইসুল স্বপন (গ্রেপ্তার), মাইনুল, আতিক, জাকির, হেলাল, টিটু, আজাদ ও শীতলের মাধ্যমে উত্তর আকারে চাকরিপ্রার্থীর কাছে যেত। পারভেজ মিয়া আলাদাভাবে প্রশ্ন দিতেন জাহাঙ্গীর জাহিদ, রবিউল ইসলাম এবং জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সোহেল রানার কাছে। তাঁরা কবীর, প্রবীর, নবাব ও সুমনের কাছে প্রশ্ন দিতেন। উত্তরা, মিরপুর ও গাবতলীতে চক্রের সদস্য জাহিদ, জানে আলম মিলন ও মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের তত্ত্বাবধানে গত ৬ নভেম্বরের পরীক্ষার আগের রাতে ৬০ জনকে উত্তর মুখস্থ করানো হয়। মাতুয়াইলের একটি বাসার বুথে মমিন ও সামাদ ১০ জনকে উত্তর মুখস্থ করান। একইভাবে শাওন, হাকি, কাফি, রাজীব, লিটু, উজ্জল ও গোলাম রব্বানীর বাসার বুথে উত্তর মুখস্থ করানো হয়।
মোক্তারুজ্জামান রয়েল জবানবন্দিতে জানান, আগের চার নিয়োগ পরীক্ষায় দেলোয়ার ও পারভেজের সহায়তায় তিনি প্রশ্ন পেয়েছেন। প্রশ্ন আকারে তাঁদের কাছে সেটি থাকলেও ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ চুক্তিতে আসা চাকরিপ্রার্থীদের তাঁরা উত্তর তৈরি করে দিতেন। এ জন্য হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করতেন ব্যাংকাররা। তাঁরাই চাকরিপ্রার্থী ঠিক করতেন।
জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহাদত হোসেন সুমা বলেন, ‘চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারাও সন্দেহের বাইরে নন।’
সূত্র জানায়, পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা (বরখাস্ত) মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের সঙ্গে মিলে জালিয়াতচক্রে জড়িয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের যুগ্ম পরিচালক আলমাস আলী। পরীক্ষার সিট কোথায় পড়বে এবং ভাইভা বোর্ডে কারা থাকবেন, সেটা জানাতেন তিনি। ৬ নভেম্বরের পরীক্ষায়ও আলমাস তিন প্রার্থীকে পাঠিয়েছিলেন মিলনের কাছে। সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় মামলার এজাহারে আলমাসের নাম দিয়েছে পুলিশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিসিটিভি অপারেটর নিয়োগে জালিয়াতির ঘটনায় আরেক যুগ্ম পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাবুদ ও আলমাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির তদন্তে গত বুধবার পর্যন্ত পাঁচ বাংকারসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা শামসুল হক শ্যামল, আহছানউল্লার কর্মী রয়েল ও পূবালী ব্যাংকের মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের দুই দিন এবং জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা এমদাদুল হক খোকন, সোহেল রানা ও চাকরিপ্রার্থী এ বি জাহিদের এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ৬ নভেম্বরের রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের দুই পদের লিখিত পরীক্ষাও সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
Comments are closed.